Saturday, April 20, 2024
HomeHomeইচ্ছাপত্র এবং অন্যান্য তসলিমা নাসরিন

ইচ্ছাপত্র এবং অন্যান্য তসলিমা নাসরিন

১. বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ সারারাত তারা ঘোরাফেরা করে’। তিনি চান না তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মতো বাইরে ঘোরাফেরা করুক, বেশি রাতে ঘরে ফিরুক। তিনি মনে করেন না রাত্তিরে মেয়েদের কোনও কাজ থাকতে পারে বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদেরও তিনি সেই নজরে দেখতে চান যে নজরে মধ্যযুগের অন্ধকারে নারীবিদ্বেষী পুরুষেরা দেখতো।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই যদি বিজ্ঞানমনস্ক না হন, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী না হন, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস না করেন, চরম ধর্মান্ধের মতো, চরম কূপমন্ডুকের মতো, চরম মূর্খের মতো নারীকে বৈষম্যের শেকল পরাতে চান, তাহলে সমাজের আর কার কাছ থেকে কী আশা করা যায়!

মেয়েদের ঘৃণা করতে করতে, ধাক্কা দিতে দিতে, দূরে সরাতে সরাতে দেয়ালে ঠেকিয়েছে সমাজপতিরা। তারপরও স্বস্তি নেই। গৃহবন্দি করতে চায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ছাত্রীদের। যতই তারা শিক্ষিতা হোক, তাদের গন্তব্য, কোনও নামী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্ত্রী বা পরিচালিকা, না, ভেবেই নেয় তাদের গন্তব্য কারও বধূ হওয়া; তাদের পতিব্রতা গৃহবধূ হিসেবেই দেখতে চায় গোটা সমাজ।

আলোর মতো অন্ধকার তসলিমা নাসরিন

যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক, সবই কাগজে কলমে। মানুষের মনে মস্তিষ্কে এখনও নারী গৃহবন্দি।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও একটি ছাত্রীনিবাসে শুনেছি ১৯৫৬ সালের একটি আইন নতুন করে বেশ চালু করা হচ্ছে। আইনটি হলো, বিবাহিত ছাত্রীরা ছাত্রীনিবাসে থাকার অনুমতি পাবে না। আমরা সাধারণত বৈষম্যে ভরপুর পচা পুরোনো নিয়মগুলোকে বাতিল করে দিয়ে যুক্তি বুদ্ধি, উদারতা মানবতা দিয়ে নতুন নিয়ম রচনা করি। কিন্তু বার বার দেখি সমাজের সর্বত্র মেয়েদের দাবিয়ে রাখার জন্য বাতিলযোগ্য নিয়মকে সামনে আনা হচ্ছে। ছাত্রী, সে বিবাহিত কী অবিবাহিত, সে বাগদত্তা কী বাগদত্তা নয়, তার প্রেমিক আছে কী নেই, সে সমকামী বা উভকামী, সে রাজনীতি করে বা করে না, শহরে তার বাড়ি আছে কী নেই, কোনও কিছুই ধর্তব্যের বিষয় হতে পারে না। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ছাত্রী বা ছাত্রাবাসে আসন থাকা চাই। যদি শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী আসন না থাকে, তবে ছাত্রাবাস এবং ছাত্রীনিবাসের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু বিবাহিত বলে তাকে স্বামীর বাড়ি বা শ্বশুর বাড়িতে বাস করার পরামর্শ দেওয়া একেবারেই অনুচিত। শিক্ষার্থীদের জন্য হস্টেলে বাস করে শিক্ষা অর্জন করা সুবিধেজনক। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন নয়, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সচেতনতা, সমানাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পরিবেশও পাওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বরং প্রেরণা দেওয়া উচিত যেন হস্টেলে থেকে শিক্ষার্থী জীবন সমৃদ্ধ করে। কর্মজীবনের পাথেয় অর্জিত হয় শিক্ষার্থী জীবনে।

ছাত্রীনিবাসে যথেষ্ট আসন নেই, সুতরাং বিবাহিতাদের কালো তালিকাভুক্ত করা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, রীতিমত অন্যায়। মানুষ ভেবেই নিয়েছে বিবাহিতাদের লেখাপড়া করার দরকার নেই, তাদের স্বনির্ভর হওয়ার দরকার নেই, তাদের স্বামীই তাদের খাওয়া পরা দেবে। সমাজে সে কারণেই দেখি, বিয়ের পর মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, চাকরি বাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিবাহিত মেয়েদেরও যে নিজের নিরাপত্তার জন্য স্বনির্ভর হওয়া জরুরি, তাদের যে পরনির্ভর হওয়া ভীষণই ঝুঁকিপূর্ণ- তা এত ডিভোর্স, এত বধূনির্যাতন দেখার পরও লোকের বোধগম্য হয় না।

হুঁশ আর কবে হবে! সময় তো বয়ে যায়।

৩. আজকাল কিছু কিছু ভালো বাংলা ছবি বানানো হচ্ছে। কিন্তু ছবির গল্পগুলো এখনও প্রচ- পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পায়নি। বছর পাঁচেক আগে বানানো খুব জনপ্রিয় ‘প্রাক্তন’ ছবির কথাই ধরি। ছবিটি যে মানসিকতা প্রচার করেছে, সেটি আজও বাংলার ঘরে ঘরে। প্রচ- এক পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ উজানের সঙ্গে সংসার করার প্রচুর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সুদীপা ডিভোর্স দিয়েছিল। কিন্তু তারপর সেই সুদীপাকে দিয়েই পরিচালক বলিয়ে নিয়েছেন সুদীপার আরও আপস করার দরকার ছিল, আরও সময় দেওয়ার দরকার ছিল, স্বামীকে আরও সুখী রাখার দরকার ছিল। ঠিক মলি, উজানের দ্বিতীয় স্ত্রী, যেমন সুখী রাখছে।

সংসারে পুরুষকে সুখী রাখতে হলে পুরুষের হিংসে, ঈর্ষা, পুরুষের দুর্ব্যবহার, দুঃশাসন মেনে নিতে হবে; পুরুষের ঔদ্ধত্য, অহংকার মানতে হবে। অবজ্ঞা, অপমান সইতে হবে, নির্যাতন সইতে হবে। নিজের মতো নয়, পুরুষের ইচ্ছে মতো চলতে হবে, তাহলেই সুখী হবে পুরুষ।

সত্যিকার সাহসী মেয়েদের, নিয়ম ভাঙতে পারা মেয়েদের, সচেতন মেয়েদের গল্প কবে শুনবো? কবে আমাদের সিনেমাওয়ালারা বুঝবেন, মেয়েরা নিজের মতো চললে যে পুরুষেরা অসুখী হয়, তাদের সঙ্গে সুখের সংসার করা কোনও সচেতন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু সিনেমার নির্মাণ উন্নত করলে চলবে না, সিনেমার গল্পকেও উন্নত করতে হবে।

সেই পঞ্চাশ ষাটের দশকে যেমন দেখাতো, আধুনিক মেয়ে মানেই খারাপ, তারা মদ সিগারেট খাচ্ছে, পরপুরুষের সঙ্গে নাচছে। ওই পুরোনো মানসিকতা নিয়ে এখনও পড়ে আছে আমাদের সমাজ এবং সিনেমা। আধুনিকতার ইতিবাচক অর্থ করতে হবে, স্বাধীনচেতা এবং স্বনির্ভর মেয়েদের- মদ সিগারেট তারা খাক বা না খাক, পার্টিতে নাচুক বা না নাচুক, বিয়ে করুক বা না করুক, ডিভোর্স দিক বা না দিক, শুয়ে বেড়াক বা না বেড়াক- সম্মান করতে হবে।

৪. আশি নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে দেখতাম শিল্পী সাহিত্যিক পেশাজীবী ব্যবসায়ী সকলে বামপন্থী। সরকারি মন্ত্রী আমলা সকলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। বামপন্থা ছাড়া আর কোনও পন্থায় তারা বিশ্বাস করে না।

বাংলাদেশের মন্ত্রী মুরাদ হাসান খুব ব্রুটালি মাহিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে -Taslima Nasrin

অবাক কান্ড, যখনই বামফ্রন্ট সরকারের পতন হতে শুরু হলো, অধিকাংশ লোক ধীরে ধীরে নতুন দলের সঙ্গে ভিড়ে গেল। নতুন দল ক্ষমতায় এলে ঠিক বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে যেমন অঙ্গাঙ্গী মিশে ছিল, তেমন মিশে গেল। অনেকটা এক কোষী অ্যামিবার মতো, যে কোনও আকার ধারণ করতে পারে। মনেই হয়নি তারা কোনও বহুকোষী প্রাণী।

এখন আবার নতুন আরেকটি দলের ঝান্ডা উড়ছে। এটিকে বেশ শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে। এটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আঁচ করে অনেকেই দ্বিতীয় দল ছেড়ে তৃতীয় দলটিতে ভিড়ছে অথবা ভেড়ার স্বপ্ন দেখছে।

এরা প্রথম দলের ঘিটা খেয়েছে। দ্বিতীয় দলের ছানাটা খেয়েছে। তৃতীয় দলের মাখনটার ওপরও লোভ করছে। এরা আসলে কোনও রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাস করে না। এরা বিশ্বাস করে ঘি ছানা মাখনে। বিশ্বাস করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ায়।

 

আজ যদি বামফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় আসে, দলে দলে ডান থেকে বামে চলে যাবে এরা। এদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল, হেমন্তের ঝরা পাতার মতো কবেই ঝরে গেছে।

নিঃস্বার্থ মানুষদেরই আমি শিল্পী বলে মনে করি। শিল্পীর অসততা, অহৃদ্যতা, লোভ, লালসা শিল্পকে মেরে ফেলে না, তবে শিল্পকে মেকি করে ফেলে।

৫. বাংলার প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র কিছুদিন আগে মারা গেছেন। শাঁওলি মিত্রর মৃত্যুসংবাদ আমাকে বড় হতবাক করেছে। চেনা মানুষগুলো, যাঁদের ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, তাঁদের যেন হই রই করে চিরকাল বেঁচে থাকার কথা। কার যে গোপনে বয়স বাড়ে, কার যে অসুখ করে, জানা হয় না।

২০০৭ সালে আমাকে যখন কলকাতা থেকে বের করে দিয়ে দিল্লিতে গৃহবন্দি করা হয়েছিল, হাতে গোনা ক’জন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন, শাঁওলি মিত্র ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি আমাকে ফোন করতেন, মনে সাহস দিতেন। আমি চিরকালই তাঁর গুণমুগ্ধ। মনে আছে আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে সেই কতকাল আগে অডিও ক্যাসেটে তাঁর নাথবতী অনাথবৎ শুনতাম। শুনতাম আর তাঁর জন্য বুকের মধ্যে একটু একটু করে ভালোবাসা জমা হতো। সেই শুরু।

তারপর তো মঞ্চে তাঁর নাটক দেখেছি, তাঁর অভিনয় দেখেছি অপলক। এমন অবিশ্বাস্য প্রতিভা নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়!

প্রিয় মানুষেরা, না হোক তাঁদের সঙ্গে দেখা বা ওঠাবসা, চলে গেলে বড় খালি খালি লাগে পৃথিবী।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর কলকাতার মানুষ যেভাবে শ্রদ্ধা জানাতে পথে নেমে এসেছিল, ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল তাঁর মৃতদেহের বাহন, শাঁওলি মিত্রের বেলায় তেমন কিছুই হয়নি। হয়নি কারণ তিনি একটি ইচ্ছাপত্র লিখে গিয়েছিলেন, কেউ যেন তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি করিয়ে তাঁর কষ্ট বৃদ্ধি না ঘটায়, তিনি কোনও আসুরিক চিকিৎসার পক্ষপাতী নন। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর দ্রুত যেন তাঁর সৎকার করা হয়, বাইরের মানুষ যেন কেউ না জানে যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মৃতদেহে ফুলভার তিনি চাননি। তাঁর ইচ্ছে পূরণ করা হয়েছে। শাঁওলি মিত্রর ইচ্ছেটি তাঁর পিতা বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী শম্ভু মিত্রের ইচ্ছের মতোই, ভক্তকুলের অগোচরে তাঁরও শেষকৃত্য হয়েছিল।

শাঁওলি মিত্রর ইচ্ছাপত্রটি আমাকেও একটি ইচ্ছাপত্র লেখার প্রেরণা দিয়েছে। আমার ইচ্ছাপত্রটি অবশ্য তাঁর ইচ্ছাপত্রের একেবারেই বিপরীত। সেটি এরকম :

“আমি চাই আমার মৃত্যুর খবর প্রচার হোক চারদিকে। প্রচার হোক যে আমি আমার মরণোত্তর দেহ দান করেছি হাসপাতালে, বিজ্ঞান গবেষণার কাজে। কিছু অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কারও জীবন বাঁচুক। কারও চোখ আলো পাক। প্রচার হোক, কিছু মানুষও যেন প্রেরণা পায় মরণোত্তর দেহ দানে।

অনেকে কবর হোক চান, পুড়ে যাক চান, কেউ কেউ চান তাঁদের শরীর পোড়া ছাই প্রিয় কোনও জায়গায় যেন ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কেউ কেউ আশা করেন তাঁদের দেহ মমি করে রাখা হোক। কেউ আবার বরফে ডুবিয়ে রাখতে চান, যদি ভবিষ্যতে প্রাণ দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়!

অসুখ বিসুখে আমি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত করবো। কোনও প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, ঠিক যেমন বিশ্বাস নেই কোনও কুসংস্কারে। জীবনের একটি মুহূর্তেরও মূল্য অনেক। তাই কোনও মুহূর্তই হেলায় হারাতে চাই না। মরার পর আমরা কিন্তু কোথাও যাই না। পরকাল বলে কিছু নেই। পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই। মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি। আমার জীবন আমি সারাজীবন অর্থপূর্ণ করতে চেয়েছি। মৃত্যুটাও চাই অর্থপূর্ণ হোক।”

 

Source : bd-pratidin

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

ইচ্ছাপত্র এবং অন্যান্য তসলিমা নাসরিন



Hero

Welcome to the future of building with WordPress. The elegant description could be the support for your call to action or just an attention-catching anchor. Whatever your plan is, our theme makes it simple to combine, rearrange and customize elements as you desire.

Translate »