গৃহ স্বামী (হাউস হাসব্যান্ড) — পর্ব ২
পরদিন রাতে হাসান দোতলায় গিয়ে নাজলির সামনে বসে ইতস্তত করে একসময় কথা বলা শুরু করলো।
“ম্যাডাম, আপনি হঠাৎ করে এমন অসম্ভব এক কথা বলেছেন যে তারপর থেকে আমার মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি,তেলে জলে মিশ খায় না। সম্পর্ক হতে হয় সমানে সমানে। আর এখানে আপনার আমার মাঝে পাঁচ তলা ও গাছ তলার চেয়েও বেশি ব্যবধান।”
হাসানের কথার এই পর্যায়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে নাজলি একটু অসহিষ্ণু কন্ঠে বললো, অতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হবে না। এ প্রস্তাবে তোমার সম্মতি না থাকলে তা স্পষ্ট করে বললেই হবে। আমি তোমার কোনো ব্যাখ্যা শুনতে আগ্রহী নই।
“ম্যাডাম, আমার কথা কিন্তু শেষ করি নি। আপনার শুনতে আপত্তি থাকলে এখন না হয় চলে যেতে পারি। আপনার মন চাইলে তখন আবার বলবো। আমি কি তাহলে চলে যাবো?”
ততক্ষণে নাজলি মনে মনে ভাবছে,হাসান যদি যে কোনো কারনেই হোক ওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে নিজের কাছেই তো ভীষণ রকমের লজ্জিত বোধ করবে। তাছাড়া এই কথা আদৌ কি গোপন থাকবে! সেরকম কিছু হলে ওর পিছনে লোকজন যে হাসাহাসি করবে তা ফেরাবে কি করে! তাহলে কি হাসানের কাছে প্রস্তাব দেয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো? তখন তো মনে হয়েছিলো এমন প্রস্তাব পেয়ে ও আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হবে। এতদিন পর্যন্ত ব্যবসার বড়ো বড়ো কতো সিদ্ধান্ত নির্ভুল ভাবে নিয়ে ওর আত্মবিশ্বাস ছিলো অনেক উঁচু পর্যায়ে। কিন্তু মনের খেলায় ও সম্ভবত কাঁচা কাজ করে ফেলেছে। এখন হাসান আশাব্যঞ্জক কিছু বলে কিনা দেখা যাক। নইলে মান ইজ্জত আর থাকলো না। কিন্তু মনের এসব ভাবনা বাইরে বিন্দুমাত্র বুঝতে না দিয়ে একটু রুঢ় কন্ঠে ও বললো,
“আবার আসতে হবে কেন? কিছু বলার থাকলে এখনই বলা শেষ করে চলে যাও। বারবার আসাযাওয়া করে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করাটা আমি পছন্দ করবো না। তোমার যা বলার তাড়াতাড়ি শেষ করে চলে যাও।”
“ম্যাডাম, অনেক সম্পদশালী বড়লোক তাদের চেয়ে অনেক নিচু সামাজিক মর্যাদার পরিবার থেকে ছেলের জন্য সুন্দরী রুপবতী পুত্রবধূ বাছাই করে আনেন। তারা নিশ্চয়ই বুঝেশুনে এটা করেন। তবে উঁচু তলার কন্যার সাথে নিচুতলার পাত্রের বিয়ে সম্বন্ধ করে হয় কিনা আমার অন্ততঃ জানা নেই। হলেও এতে অনেকরকম জটিলতা অবশ্যম্ভাবী। এই প্রস্তাবে আমি সম্মত হলে আপনি গতকাল যা বলেছেন পরবর্তীতে তার বাইরেও আরও বেশকিছু সমঝোতা আমার করতে হবে, ছাড় দিতে হবে এটা বুঝতে পেরেও সবদিক ভেবে চিন্তে আমি একটা মাত্র সাধারণ শর্তে আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি। শর্তটা আপনার জন্য কঠিন কিছু নয়। আপনি আগ্রহী হলে সেটা বলতে পারি।”
“আগ্রহ অনাগ্রহ পরে বিবেচনা করা হবে। তোমার শর্তটা কি শুনে দেখি আগে। তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু সেজন্য আমি অন্যায়, অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য কোনো শর্ত মেনে নেবো তা কিন্তু ভুলেও মনে করো না। এখন বলো কি বলতে চেয়েছিলে।”
“ম্যাডাম, আমার বাবা-মা’র মৃত্যুর পরে যার কাছে আশ্রয় পেয়েছি, যিনি নিজে না খেয়েও আমাকে খাইয়েছেন আপনার পক্ষ থেকে আমার সেই ফুপুর আরাম আয়েসের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করলে আমার জীবনে যা-ই ঘটুক বিয়ের পর আমি আপ্রান চেষ্টা করবো সম্পর্কে সৎ থেকে আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী চলার। সুখ দুঃখ আল্লাহর হাতে। আমার অদৃষ্টে যা-ই থাক ফুপু আম্মা শেষ বয়সে একটু সুখের মুখ দেখলে তাতেই আমার মনে শান্তি পাবো। আপনি কি এই ব্যপারটা বিবেচনা করতে রাজি হবেন?”
নাজলি রহমান একটু সময় ভেবে নিয়ে বললেন, এটা বিবেচনা না করার মতো কোনো বিষয় নয়। আমি বরং তোমার মনোভাব দেখে যুগপৎ অবাক ও খুশি হয়েছি। আজকাল গর্ভধারিণী মায়ের কথা ক’জন লোক এভাবে চিন্তা করে? সেখানে তুমি তোমাকে লালনপালন করা ফুপুকে নিয়ে এতোটা ভেবেছ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কিন্তু তোমার ফুফুকে এখানে এনে রাখতে চাইলে তাঁর এবং আমাদের কারোর জন্যই সেটা স্বস্তিদায়ক না হতে পারে। বরং তিনি যাতে নিজ বাড়িতে আরাম আয়েশে বাকি জীবন কাটাতে পারেন সে দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তাঁর ভরনপোষণ ছাড়াও সেবা করার জন্য সার্বক্ষণিক একজন লোক রেখে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ নিয়ে তোমার আর চিন্তা করতে হবে না। আমরা তাহলে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিতে পারি। আর এখন থেকে আমাকে ম্যাডাম বা আপনি বলতে হবে না। বিয়ের পর তুমি এভাবে সম্বোধন করলে সেটা যেমনি হাস্যকর দেখাবে তেমনি বাসার কর্মচারীরা হাসাহাসি করবে। তাছাড়া তোমার মর্যাদা রক্ষা করা আমারও তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ঠিক আছে হাসান। আমি এ বিষয়টা নিয়ে আর একটু ভেবে তারপর তোমার সাথে আবার বসবো। আপাততঃ বিদায়।”
কথা এভাবে শেষ করে নাজলি ওকে চলে আসতে বলায় হাসান মনে মনে হাঁপ
ছেড়ে বাঁচলো। এমন ব্যক্তিত্বশালী নারীর সামনে বেশিক্ষণ থাকলে আসলেই ওর ভাবনা চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়।
তারপর কেটে গেছে আরও একটা দিন। এর মাঝে হাসানের সাথে নাজলির ঐ বিষয়ে কোনো কথা না হওয়ায় ও মনে করেছে বড়োলোকের খেয়াল আসতেও সময় লাগে না আবার যেতেও সময় লাগে না। নিজে নিজে পরিকল্পনাটা বাদ হয়ে গেলেই ভালো।
কিন্তু শুক্রবার সকালে নাস্তার পরে নাজলি হাসানকে সঙ্গে করে নিয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে বসতে বললো। এর আগে ঐ বেডরুমে কখনো ঢোকা হয় নি ওর। বিশাল বেডরুমের মাঝখানে গোলাপি চাদরে আবৃত ডাবল খাট। একপাশে দেয়াল ঘেঁষে দুটি সিঙ্গেল সোফা। তার সামনে সুদৃশ্য টি-টেবিল। হাসান একটা সোফায় বসার পর নাজলি বিছানায় বসে বললো, তোমার আপত্তি না থাকলে এক সপ্তাহ পর আগামী শুক্রবার বিকেলে আমরা বিয়েটা সেরে ফেলতে পারি। এটা যেহেতু সমঝোতার বিয়ে তাই ধুমধাম করে বিদেশ থেকে শপিং করার কোনো যুক্তি নেই। আমরা লৌকিকতার ধার না ধেরে ঢাকা থেকেই বিয়ের বাজার করে ফেলবো এবং আমাদের বাসায় ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার এনে এখানেই বিয়েটা সেরে ফেলবো। বিয়েতে স্বামীর কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। তোমার কাছে এ মুহূর্তে কতো টাকা আছে আমাকে বলো। তারপর একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলি।”
হাসানের এতক্ষণে বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। বিয়েটা তাহলে ওর করতেই হচ্ছে। সামনে কতো যেন বিড়ম্বনা অপেক্ষা করছে কে জানে।
এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে ও বললো, হাতে নগদ টাকা তেমন নেই। ব্যাংকে লাখ দুয়েক আছে। এই টাকায় কি সবকিছু সম্ভব হবে?
“হবে মানে? রীতিমতো দৌড়াবে। তুমি পরশু নাগাদ ওখান থেকে এক লাখ টাকা উঠিয়ে নিজের কাছে রাখবে। পরদিন সোমবার লাঞ্চের পরে আমরা বসুন্ধরা শপিংমলে মার্কেটিং করতে যাবো। তোমার কোনো আপত্তি থাকলে এখনো বলতে পারো।”
হাসানের মন বলছে কোনো একটা অজুহাত তুলে বিয়েটা আপাততঃ হলেও বন্ধ করা উচিৎ। কিন্তু ঐ নারীর সম্মুখে এতক্ষণ বসে থাকার পর ওর চিন্তা ভাবনা স্বাভাবিক ভাবে আর কাজ করছে না। কোনো কথা মাথায় বা মুখে আসছে না। ওর এই নিরবতাকে সম্মতি ভেবে নিয়ে নাজলি ওকে সোমবারের কথা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে চলে যেতে বললো।
সোমবার বিকেলে বসুন্ধরা শপিং মলে পৌঁছে নাজলির পিছনে পিছনে ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডে ঢুকলো। ওরকম জাঁকজমকপূর্ণ জুয়েলারীর দোকানে ঢুকে হাসানের বুক কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। এখান থেকে কিছু কিনে দিতে হলে কতো টাকা দরকার হয় কে জানে।
নাজলি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে অনেকগুলো ট্রে থেকে একটা হীরের ওয়েডিং রিং ও হীরের একটা নোজ পিন পছন্দ করে হাসানকে জিজ্ঞেস করলো পছন্দ হয় কিনা।
হাসান এসবের কি বুঝে? তাছাড়া ওর চিন্তা হলো এই জিনিসের কতো দাম কে জানে। ওর তো বিন্দুমাত্র ধারনাও নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাড়াতাড়ি বললো, দুটোই খুব সুন্দর। নাক ফুলটায় তোমাকে খুব মানাবে।
হঠাৎ যেন নাজলির মুখমন্ডলে রক্ত ছড়ালো। হাসান এই প্রথম ওকে তুমি করে বললো এবং পরোক্ষভাবে প্রশংসা করলো। ওর মুখের রক্তিমাভা লুকাতে তাড়াহুড়ো করে হাসানকে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, টাকা এনেছ সঙ্গে করে?
ও ইশারায় হ্যাঁ বুঝাতে সেখান থেকে সাতানব্বই হাজার টাকা কাউন্টারে জমা দিয়ে রশিদ ও জিনিস দুটি সহ বাইরে বের হয়ে বললো, আমার তো গয়না পরার অভ্যাস নেই। কিন্তু বিয়েতে একেবারে কিছু না নিলে খারাপ দেখায়। তাছাড়া স্ত্রীকে কমপক্ষে এই দুটি জিনিস উপহার দেয়া স্বামীরও দায়িত্ব। চলো, এখন তোমার আমার বিয়ের পোশাক সহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে ফেলি। তোমার জন্যও আঙটি কিনতে হবে। সবশেষে তোমার লাখ টাকা থেকে যা উদ্বৃত্ত আছে ঐ টাকা দিয়ে আমাকে বাইরে কোথাও খাওয়াবে। এটাও কিন্তু ছেলেদের দায়িত্ব। ফাঁকি দিলে চলবে না বাপু। এরপর মিষ্টি করে হাসলো।
নাজলিকে হাসান এতদিন বস হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিলো। কোনোদিন ওর সামনে এতটুকু লঘু হতে দেখে নি। তাহলে এই বিয়েটা কি ও খুশি মনে করছে? শুধুমাত্র পরিস্থিতির প্রয়োজনে সমঝোতা নয়? অমন কঠোর ব্যক্তিত্বশালী নাজলিকে সামান্য ঐ হাসির কারনে আজ একেবারে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
ওরা কতক্ষণ ঘুরেফিরে নাজলির পোশাক, কসমেটিকস ছাড়াও হাসানের জন্য আঙটি, ঘড়ি, জুতো, পোশাক এবং লুবনান থেকে দামী একটা পাঞ্জাবি কিনলো। তারপর ওখানকার ফুড কোর্টে গিয়ে নাজলি খাবার অর্ডার করলো। খাওয়া শেষ হলে হাসান বিল পরিশোধ করে মনে মনে একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করলো। কিন্তু এই আনন্দ, স্বস্তি যে একেবারেই সাময়িক তখনও ও বুঝতে পারে নি।
পরবর্তী শুক্রবার বিকেলে নাজলির গুলশানের বাসায় দু’জন বন্ধু এবং ওর চাচার উপস্থিতিতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। নাজলির ইচ্ছে অনুযায়ী দেনমোহর নির্ধারণ হলো এক লক্ষ টাকা এবং তার পুরোটাই গয়না বাবদ উসুল দেখানো হলো।
সন্ধ্যার পরপর চাচা চলে যাওয়ার আগে হাসানকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন,”তুমি তো আর নাজলিকে বিয়ে করো নি। বরং আমার ভাতিজি তোমাকে বিয়ে করেছে। অনুগত গৃহস্বামী হয়ে তোমার বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। আশা করি এটা জেনে-বুঝেই তুমি এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছ। আর যদি মনে করো, নাজলির ধনসম্পদ হাতিয়ে সুযোগমতো পালিয়ে যাবে সে গুড়ে বালি। ওর বাবার মৃত্যুর পরে তার সম্পত্তিতে আমার ন্যায্য পাওনা আমার মতো লোকও পুরোটা বুঝে নিতে পারি নি। সেখানে তুমি তো ওর এককালের বাবুর্চি ছাড়া কিছু নও। বুঝেশুনে চললে নিজের ভালো হবে। মনে রেখো, ঐ মেয়ের সামনে দুটি চোখ ছাড়াও পিছনেও এক জোড়া চোখ আছে।”
কথাগুলো শুনে হাসানের মন তিক্ততায় ভরে গেলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ রইলো।
বিয়ে হলেও ওদের বাসরশয্যা ফুল মালা দিয়ে আলাদাভাবে সাজানো হয় নি। হাসানের মনে এমন কোনো প্রত্যাশাও ছিলো না। নাজলির মতো ধনবতী উঁচু ক্লাসের নারীর সাথে ওর যে বিয়ে হয়েছে এটাই নিজের কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। ও বরং নাজলির কাছ থেকে ওর দায়িত্ব কর্তব্য এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নতুন কিছু শোনার অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু নাজলি ওরকম কোনো প্রসঙ্গ প্রথম দিন উত্থাপন না করায় মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
ভালোয় ভালোয় ওদের বাসররাত কেটে গেছে। ত্রিশোর্ধ দুই বিবাহিত তরুন তরুনী জীবনের স্বাভাবিক চাহিদায় একসময় ঘনিষ্ঠ হলো। এরপর হাসানের মনের শঙ্কা অনেকটা কেটে গেছে। নরনারী পরস্পরের কাছে স্বতস্ফূর্তভাবে একবার বেআব্রু হলে তাদের সম্পর্ক সাধারণত অনেক সহজ হয়ে যায়। সে কারনে হাসান যখন নিজের মনে বেশ খানিকটা সহজ ও নির্ভার অনুভব করছে তেমন অবস্থায় পরদিন সকালে নাস্তার পরে নাজলি ওকে বললো, আজকে আর অফিসে যাবো না। বাসায় কল করে যেন বিরক্ত না করে অফিসে সেটা জানিয়ে দিয়েছি।
নাজলির এতটুকু কথা শুনে হাসান মনে মনে পুলকিত অনুভব করা শুরু করেছে। ও ভেবেছে বাসায় থেকে মনে হয় অন্তরঙ্গ সময় কাটানোই নাজলির ইচ্ছে। তার মানে ওকে স্বামী হিসেবে নাজলি পছন্দ করে ফেলেছে বা ওকে যোগ্য স্বামী মনে করছে।
ওর এই ভাবান্তর নাজলির চোখে পড়ায় বেশ একটু অসন্তুষ্টি নিয়ে কিঞ্চিৎ রুঢ় কন্ঠে ও বললো, “বাসায় থাকা মানে দিনের বেলা তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবো এমন কিছু ভুলেও আশা করো না। আমার কোনো কিছু প্রয়োজন হলে সেটা আমি নিজেই তোমাকে বলবো। তুমি নিজ থেকে কখনো ওসব কিছু বলতে এসো না। এ ছাড়াও তোমার সাথে কিছু কথা খোলাখুলি আলাপ করে নিতে চাই। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে সেজন্য পস্তাতে হয়।”
গতরাতের নাজলি আর এই নাজলি যেন আলাদা দু’জন মানুষ। ও এখন ব্যক্তিত্বের আলাদা এক খোলসে নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলেছে। হাসানের বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেছে। কি জানি কোন কথা শুনতে হয় প্রচন্ড ব্যক্তিত্বশালী এই নারীর কাছ থেকে।
“হাসান, তোমাকে পছন্দ করার মতো একাধিক কারন আছে। তুমি শিক্ষিত, সৎ ও দায়িত্বশীল। খারাপ কোনো স্বভাব এতদিনে চোখে পড়ে নি। আর এ কারনেই তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি তুমি আমাকে হতাশ করবে না। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে কিছু কথা স্পষ্ট করে নেয়া উচিৎ। তুমি আগে যেভাবে আমার খাওয়াদাওয়া সহ বাসার সবকিছু সুচারুরূপে ম্যানেজ করেছ সেটা যেন বজায় থাকে। আমার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা তোমার মূল দায়িত্ব। তবে তোমার যাতে সম্মানহানি না হয় সেজন্য তুমি চাইলে যোগ্য দেখে একজন নতুন কুক নিয়োগ দিতে পারি। অফিসের বা ব্যবসার কাজে তোমার কোনো ভূমিকা থাকবে না। ওসব যে আমি ভালোভাবে সামলাতে পারি তা তো দেখতেই পাচ্ছ। আর একটা ব্যাপার না বললেই নয়। বেড শেয়ার করা আমার পছন্দ নয়। ছোটবেলা থেকেই একা একা ঘুমানো অভ্যাস। আমার পক্ষে হঠাৎ করে তা পাল্টানো সম্ভব হবে না। তোমার জন্য পাশের রুমটা গোছগাছ করে রাখা হয়েছে। গতকাল তো বলতে গেলে আমরা শেষ রাতে ঘুমিয়েছি। তা-ও ক্লান্তির কারনে। তুমি সুপুরুষ তা অস্বীকার করবো না। তোমাকে এখন মনে হয় আগের চেয়েও একটু বেশি পছন্দ করি। আমার যেদিন মন চাইবে তোমাকে রুমে ডেকে নেবো। এমনকি কোনো রাতে হয়তো তোমার রুমেও ঢুকে পড়তে পারি। তবে সময় অসময় তুমি যেন আবার বিরক্ত করতে না আসো।
আমার স্বামী হিসেবে তোমার মান-মর্যাদা বা যে কোনো প্রয়োজনের দিকে আমি খেয়াল রাখবো। তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। আগামীকাল তোমার ব্যাংক হিসাবে দশ লাখ টাকা জমা হয়ে যাবে। আমার অফিসের এক লোকের বাড়ি তোমাদের ওদিকে। তোমার ফুপুর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তুমি সময় করে একবার গিয়ে তোমার ফুপুর সাথে দেখা করে আয়োজনে ত্রুটি আছে কিনা পরীক্ষা করে আসতে পারো। তবে তিনি বউ দেখার আব্দার করলে একটা কিছু বলে এড়িয়ে যাবে। বুঝতেই পারছ, আমি এ দেশের বা এই সমাজের মানদণ্ডে আদর্শ বউ কখনোই হতে পারবো না।
আমার কথাগুলো রুঢ় শোনালেও ভবিষ্যতেের শান্তি ও স্বস্তির জন্য এটা বলা দরকার ছিলো। তোমার কিছু বলার থাকলে তা নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”
হাসান ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে, ওর এই বাসায় স্রেফ গৃহস্বামীর ভূমিকায় থাকতে হবে। এর বাইরে কিছু চিন্তা করলে পায়ের সোনার শেকল কেটে খাঁচার দরজা খুলে চলে যেতে হবে। হয়তো একদিন তা-ই করতে হবে। কিন্তু তার আগে দেখা যাক ফুপু আম্মার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা কতদূর কি হয়েছে। যে মানুষটা নিজ সন্তানের মতো ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, কিছু ছাড় দিয়ে, কিছুটা সমঝোতা করেও যদি তাঁর সুখ নিশ্চিত করা যায় তাহলে হাসিমুখে অনেককিছু মেনে নেয়ার জন্য ও নিজের মনকে বোঝালো।
এক সপ্তাহ যাচাই-বাছাই করে একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে পছন্দ হওয়ায় তাকে নতুন কুক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু দু’দিনের মাথায় নাজলি খেতে বসে ওর অসন্তোষ চেপে না রেখে স্পষ্ট বললো, “এই মহিলার রান্না তো মুখেই দেয়া যাচ্ছে না। সারাদিন কাজকর্ম করে রাতে বাসায় একবেলা ডিনার করি। তা-ও যদি মুখে দেয়ার মতো না হয় তাহলে কেমন লাগে বলো? তোমার হয়তো শুনতে খারাপ লাগবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিয়ে করাটা আমার ভুল হয়ে গেলো কিনা। নইলে তো আমি ভালো খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতাম না। চলো, আজ বাইরে থেকে খেয়ে আসি। আমার চেইঞ্জ করতে সময় লাগবে না। তুমি দশ মিনিটের মধ্যে পার্কিং-এ চলে এসো এবং ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো।”
নাজলি এই কথাগুলো একটু ঘুরিয়ে নমনীয় ভাবে বললে হয়তো হাসানের খারাপ লাগতো না। মনটা বিমর্ষ হলেও এ মুহূর্তে নির্দেশ পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। গাড়িতে পাশাপাশি বসলেও দু’জনের কোনো কথা হলো না। কেমন অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। দামী রেস্তোরাঁর উপভোগ্য খাবারেও হাসানের মনের বিষন্নতা দূর হলো না। আবার গাড়িতে উঠে চুপচাপ সময় কাটিয়ে ওরা বাসায় ফিরে এলো।
ঠিক সেই রাতেই নাজলি ওকে বেডরুমে আসার জন্য ইশারা করলো। মন খারাপের কারনে আজ এ জন্য হাসান একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। মন না চাইলে শরীরও তখন সাড়া দেয় না। কিন্তু অজুহাত তোলা ঠিক হবে না,তাতে নাজলি হয়তো অপমানিত বোধ করবে। অন্য সময় যে বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে ও অপেক্ষায় থাকে আজ অনিচ্ছায় দায়িত্ব পালন করার জন্য নাজলির ডাকে ও সাড়া দিতে গেলো। কিন্তু ওর এই অনিচ্ছার ব্যাপারটা সময়মতো ঠিকই নাজলির চোখে ধরা পড়ে গেছে। একসময় অসহিষ্ণু কন্ঠে ওকে বললো, শারীরিক মিলনের সময় অন্যমনস্ক থাকলে,সক্রিয় সাড়া না দিলে, সেটা কি উপভোগ্য হয়? তোমার অনিচ্ছা থাকলে আগেই বলতে পারতে! আজ খুব হতাশ করলে তুমি। ভবিষ্যতে এমন যেন কখনো না হয় সেদিকে খেয়াল রেখো।
কিন্তু হাসান খুব ভালো ভাবেই বুঝে যে ওর অনিচ্ছার কথা আগে প্রকাশ করলে পরিস্থিতি এরচেয়েও খারাপ হতে পারতো। সেই সম্ভাবনাই বেশি। একজন গৃহস্বামীর অনেক কিছুই মুখ বুজে সহ্য করে নিতে হয় সেটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। বলতে গেলে অপমানিত মনোভাব নিয়ে ও নিজের শয়নকক্ষে চলে এলো। পরদিন সকালেও বিষন্ন ভাবটা কাটছে না দেখে এই সোনার খাঁচা ভেঙে পালাবে কিনা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে লাগলো ও।
চলমান …
লিখাঃ Shahidul Islam
Source: নীলাভ্র আর নীলাম্বরীর গল্প