একাত্তরের মার্চের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ঋষিপ্রতিম অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র (জি সি) দেব। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার প্রথম সারিতে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। মৃত্যুতেই ঘটনার ইতি ঘটেনি। জি সি দেবের এক বিদেশি অনুরাগী করে চললেন তাঁর অনুসন্ধান। সম্প্রতি পাওয়া পুরোনো নথি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অভূতপূর্ব সে কাহিনি।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পল এ নাজারেক নামে এক তরুণ আমেরিকান পেনসিলভানিয়ায় গড়ে তুলেছিলেন ‘জি সি দেব ফাউন্ডেশন’। নাজারেক ছিলেন বিকল্পধারার চিকিৎসা কায়রোপ্র্যাক্টর চিকিৎসক। একাত্তরে সেই পল নাজারেকের সঙ্গেই আমেরিকান এক্সপেরিয়েন্স নামের বইটি নিয়েই আলাপে ছিলেন জি সি দেব। বেশ কিছু অংশ তিনি লিখেছেন বলে জানান। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসেও জি সি দেব আরেকবার যুক্তরাষ্ট্র যান, ওঠেন জ্যোতিপ্রকাশ আর পূরবীর বাড়িতে। অংশ নেন জি সি দেব ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ডে। ঢাকায় ফিরে পল নাজারেককে তিনি সর্বশেষ চিঠি লেখেন ২২ মার্চ।
পাকিস্তানি সেনারা যখন জি সি দেবের প্রভোস্ট ভবনের দরজায় আঘাত করছে, ঘড়ির কাঁটা তখন ২৫ পেরিয়ে ২৬ মার্চ ১৯৭১। রাতে দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকেই পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে জি সি দেব আর রোকেয়ার স্বামীকে। পেছনের বাগানের একটি ঘরে লুকিয়ে থেকে বেঁচে যান রোকেয়া। জগন্নাথ হলের আরও অগণিত ছাত্রের লাশের সঙ্গে অভিন্ন মানবধর্ম খুঁজতে থাকা ড. জি সি দেবের লাশটিও তারা মাটিচাপা দেয় হলের মাঠে।
১৯৭১ সালের মে মাসে যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অপ্রত্যাশিত চিঠি পায় সুদূর পেনসিলভানিয়া থেকে। লিখেছেন সেই ডা. পল নাজারেক। নাজারেক জি সি দেবের খোঁজ জানতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। নিশ্চিত হতে চান, তিনি বেঁচে আছেন কি না, সাহায্য চান তাঁর আমেরিকান এক্সপেরিয়েন্স বইটির পাণ্ডুলিপি উদ্ধারে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিলপত্রে দেখতে পাই, নাজারেকের এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কী উত্তর দেওয়া হবে জানতে চেয়ে রেজিস্ট্রার নথি উপস্থাপন করেছেন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বরাবর। দলিলে উপাচার্যের উত্তর দেখে আমরা মর্মাহত হলেও বিস্মিত হইনি। আমরা দেখতে পাই, তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী উপাচার্য ১৩ মে ১৯৭১ তারিখে নথিতে লিখেছেন ‘নো অ্যাকশন ফর দ্য প্রেজেন্ট’, অর্থাৎ এ বিষয়ে এখন কিছু করার দরকার নেই। জি সি দেব প্রসঙ্গটিকে স্পষ্টতই নির্মমভাবে চাপা দিতে চেয়েছেন তিনি।
১৯৬৫ সালে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগ থেকে জি সি দেবকে ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্ভাব্য যোগাযোগকারী সন্দেহে ‘প্রটেক্টিভ কাস্টডি’ হিসেবে ধরে জেলে নিয়ে গিয়েছিল। জ্যোতিপ্রকাশ তাঁর সঙ্গে জেলগেট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তিনি মনে করতে পারেন, দর্শনে ডুবে থাকা মানুষটি এই হেনস্তায় কী পরিমাণে বিপন্ন হয়েছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাশালী কারও সাহায্যে জি সি দেবকে জেল থেকে বের করে নিয়ে এলে স্বল্পস্থায়ী ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের পুরো সময়টা তিনি প্রথমে বাড়িতে, পরে হাসপাতালে গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। জি সি দেব প্রসঙ্গে পাকিস্তানপন্থী উপাচার্যের উচ্চবাচ্য করা থেকে বিরত থাকার প্রেক্ষাপটটি আমরা বুঝতে পারি।
তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নাজারেক হাল ছাড়ার পাত্র নন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ওয়াশিংটনের তৎকালীন পাকিস্তান দূতাবাসে চিঠি লিখে তাঁর প্রসঙ্গে জানতে চান। আবারও খোঁজ করেন পাণ্ডুলিপির। সেই সূত্র ধরে ওয়াশিংটন দূতাবাস ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যোগাযোগ করে জি সি দেব বিষয়ে তথ্য চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে এবার বেশ একটা আলোড়ন লক্ষ করি। আমরা দেখি, এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তারা এ বিষয়ে নথি চালাচালি করছেন। দর্শন বিভাগসহ অন্যান্য প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে চিঠি দেওয়া–নেওয়া চলে। এটি ঘটছে একাত্তরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসজুড়ে।
আমরা দেখতে পাই, অবশেষে ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঢাকার প্রটোকল অফিসারকে অত্যন্ত নির্দোষ ভাষায় জানাচ্ছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান জি সি দেব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে মারা গেছেন।’ এ তথ্য থেকে নাজারেকের পক্ষে ঘটনাটির নেপথ্যের বীভৎসতার কথা নিঃসন্দেহে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু চিঠিটি আর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর সুযোগ পায়নি। কারণ, এর পরপরই মুক্তিযুদ্ধের পটপরিবর্তিত হয়ে গেছে। পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ঢাকার। দুই সপ্তাহ পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।
আমরা দেখতে পাই, কোনো খোঁজ না পেয়ে উদ্গ্রীব নাজারেক আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন স্বাধীন বাংলাদেশেও। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই নাজারেক জি সি দেব ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আবার চিঠি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্যের কাছে। ইতিমধ্যে তিনি জেনে গেছেন জি সি দেবের মৃত্যুর খবর। নতুন উপাচার্যের কাছে এবার তিনি জানতে চান, জি সি দেবের আমেরিকান এক্সপেরিয়েন্স–এর পাণ্ডুলিপিসহ অন্যান্য বইপত্র উদ্ধার করে জি সি দেব ফাউন্ডেশনে পাঠানো যায় কি না। তিনি যে এর জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে রাজি, সে কথাও জানান।
দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নাজারেক অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে এবার লেখেন ওয়াশিংটনের নতুন বাংলাদেশ দূতাবাসে। জি সি দেবের ব্যাপারে স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েরও এমন নীরবতায় তিনি তাঁর হাতাশার কথা জানান। নাজারেক আবারও আন্তরিকভাবে জানতে চান ঠিক কীভাবে কোথায় জি সি দেবের মৃত্যু হয়েছিল। জি সি দেবের লেখা পত্র, বই ইত্যাদি সংগ্রহের আবেদন করেন তিনি। জি সি দেব যে বাড়িতে থাকতেন, তার একটি ছবিও তিনি চান।
আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশ ওয়াশিংটন দূতাবাসে নাজারেকের চিঠি পৌঁছালে এবার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি কূটনীতিবিদ এস এম আলী। তাঁর উদ্যোগে এবং তাগাদাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশেষে স্বাধীনতার প্রায় ১০ মাস পর জি সি দেবের মৃত্যুর পুরো বিবরণ জানিয়ে নাজারেককে চিঠি লেখে। চিঠিতে এ–ও জানানো হয় যে তাঁর প্রভোস্ট ভবনটি পাকিস্তানি বাহিনী তছনছ করেছে এবং পরে সেটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। এ কারণে বাড়ির কোনো ছবি তাঁরা দিতে পারছেন না এবং সেখানে তাঁর কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
জি সি দেবের একজন আন্তরিক বন্ধুর আবেদনে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গড়িমসি গ্রহণযোগ্য নয় নিশ্চয়ই, তবু আমরা এটি বিবেচনায় রাখছি যে একটি নতুন দেশের নানা প্রশাসনিক রদবদলের ভেতর এ ধরনের ব্যক্তিগত অনুরোধ রাখার পরিস্থিতি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন ছিল না। কিন্তু জি সি দেব বিষয়ে একজন বিদেশির এ কৌতূহল এবং পরবর্তীকালেও দেশের ভেতর জি সি দেব বিষয়ে কর্মকাণ্ডে আমাদের কিছু প্রশ্ন জাগে।
জি সি দেব বাংলাদেশের একজন দার্শনিক হিসেবে একসময় আন্তর্জাতিক আগ্রহের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর নামে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ফাউন্ডেশনও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বসে তাঁর সেই পরম্পরাকে কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? আমরা মনে করি, আজকের বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে জি সি দেবের দর্শনকে প্রসঙ্গিক করে তোলার প্রভূত সম্ভাবনা আছে।
আমরা মনে করি না যে জি সি দেবের প্রতি প্রাপ্য মনোযোগ এবং তাঁকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়েছে বলে। স্বাধীনতা পদক দেওয়ার মাধ্যমে জি সি দেবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হয়েছে অনেক বিলম্বে, ২০০৮ সালে।
আমরা এ–ও জানি, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর বৈষয়িক সম্পত্তির অর্ধেক দান করে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, বাকি অর্ধেক তাঁর পালক পুত্র জ্যোতিপ্রকাশ এবং পালক কন্যা রোকেয়াকে। রোকেয়া ইতিমধ্যে গত হয়েছেন। আমরা জেনেছি, দীর্ঘ চার দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর দত্তক পুত্র জ্যোতিপ্রকাশকে জি সি দেবের প্রাপ্য বেতন–ভাতা দিয়েছেন। এটি নিশ্চয়ই ধন্যবাদযোগ্য উদ্যোগ। দুই পালক সন্তানের মতোই সমান ভালোবাসার পাত্র তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জি সি দেব সমভাবে দান করে গেছেন তাঁর সম্পত্তি, যেটা ঢাকায় ধানমন্ডির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। আমাদের প্রস্তাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জি সি দেবের সেই বাড়িতে তাঁর উত্তসূরির অনুমোদন সাপেক্ষে, জি সি দেবের স্মারক একটি কেন্দ্র গড়ে তুলুক। সেই কেন্দ্রের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের পরিচয় ঘটুক তাঁর দর্শনের সঙ্গে, তারা জানুক তাঁর নির্মম মৃত্যুর ইতিবৃত্ত। বহুধাবিভক্ত আজকের এই বাংলাদেশে এবং বিশ্বে জি সি দেবের মতো ঐক্যের সন্ধানী, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী মানুষগুলোকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
দেশের জন্য জীবন দিয়েও ‘শত্রু’ আখ্যা পেলেন জিসি দেব
ড. জিসি দেব; পুরো নাম গোবিন্দ চন্দ্র দেব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে যে ক’জন বীর বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শহীদ বুদ্ধিজীবি। অথচ এই শহীদের বাড়িটিই ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আখ্যা দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে অদ্যাবধি। জাতির শ্রেষ্ট সন্তানকে কী নিকৃষ্ট প্রতিদান!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে চালায় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। সে রাতেই পাকিস্তানি হায়েনারা হত্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, মানবতাবাদী দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ড. জি সি দেব) কে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা পর্বেই স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন এই জশস্বী।
জিসি দেবকে হত্যার পরই স্থানীয় রাজাকার আর আলবদররা তাঁর পৈতৃক ঘর ও অসংখ্য দুর্লভ বই সহ সকল স্মৃতিচিহ্ন পুড়িয়ে দেয়। বাড়িটি দখল করে নেয় রাজাকারেরা। স্বাধীনতার পর রাজাকাদের মতোই ভূমিকা নেয় সরকার। জিসি দেবের বাড়িটি শত্র“ সম্পত্তি (পরবর্তীর্তে অর্পিত সম্পত্তি) আখ্যা দিয়ে দখল করে রেখেছে সরকার।
জাতির শ্রেষ্ট সন্তানের সাথে কী ভয়ংকর পরিহাস! যাঁর প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতার লাল সূর্য তার কপালেই জুটলো ‘শত্রু’ আখ্যা। সরকার যায়, সরকার আসে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিপক্ষের লোকরা ক্ষমতায় আসে। তবু জিসি দেবের বাড়িটি উদ্ধারে নেওয়া হয় না কোন উদ্যোগ। ‘শত্রু’ কলংক তিলকই লেগে থাকে জাতির এই সূর্য সন্তানের কপালে। ফলে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবী ড. জি সি দেবের পৈতৃক বাড়িটি গত ৪৪ বছর ধরে রয়েছে দখলদার চক্রের হাতে।
ড. জিসি দেবের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের নন্দিরফল গ্রামে। বাড়িটির সর্বমোট ভূমির পরিমান ২দশমিক ৪৭ একর। ব্যাক্তিগত জীবনে জিসি দেব ছিলেন অকৃতদার। তাঁর অপর ভাই যুদ্ধপূর্বকালীন সময়েই ভারতে চলে যান। তিনি সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েই জিসি দেবের বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করে সরকার।
অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অবৈধভাবে শত্রু সম্পত্তি তালিকাভূক্ত। এরপর এ বাড়িটি একের পর এক বিভিন্ন ব্যাক্তিকে লিজ প্রদান করে। সেই সময়েই স্থানীয় সচেতন এলাকাবাসী বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে জিসি দেব যাদুঘর কিংবা পাঠাঘার করার দাবী জানান। বলাবাহুল্য, সে দাবী সরকারের কর্ণকুহরে পৌছায় নি কিংবা সরকার তাতে কর্ণপাত করেন নি।
এরপর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ১৯৯২ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন এই বাড়িটি ড. জি সি দেবের নামে রেকর্ডভুক্ত করেন। বিগত সেটেলমেন্ট জরিপেও একই নামে বাড়িটি রেকর্ডভুক্ত হয়। জিসি দেবের নামে রেকর্ডভূক্ত করার সাথে সাথে স্বভাবতই বাড়িটির লিজ গ্রহীতারা অবৈধ দখলদার হয়ে যায়। তবে রহস্যজনক কারনে অধ্যাবদি অবৈধ দখলদারদেরকে বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ করা হয় নি।
এদিকে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল বাড়িটি তাদের দখলে নেয়ার জন্য নানা পায়তারা শুরু করে। সরকারের স্থানীয় সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দখলদাররা এ বাড়িতে অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখনও দখলদাররা অবৈধভাবে বসতঘর বানিয়ে জিসি দেবের বাড়িতে বসবাস করছে। স্থানীয় প্রশাসনও বাড়িটি উদ্ধারের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে বাড়িটি নিয়ে প্রশাসন, অবৈধ দখলদার ও স্থানীয় সচেতন মহলের মধ্যে চলছে ত্রিমুখী লড়াই।
ছ’বছর আগে ড. জি সি দেব স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি উদ্ধারে জন্য সরকারীভাবে কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয় সাংসদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবরেও এ ব্যাপারে দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসীরা।
রাজাকারপুত্রের দখলে শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের পৈতৃক ভিটা
স্বাধীনতার পরও দখলমুক্ত হয়নি আধুনিক মানবতাবাদী দর্শনের পথিকৃৎ শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (ড. জি সি দেব) পৈতৃক ভিটা। ২০০৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করে জাতি আংশিক দায়মুক্ত হলেও বাড়িটি দখলমুক্ত করতে না পারায় হতাশ সিলেটের বিয়ানীবাজারবাসী। তাঁর বাড়ির কিছু অংশ দখল করে আছে এক রাজাকারপুত্র। স্থানীয় সুধীসমাজের দাবি, অনতিবিলম্বে পুরো বাড়ি দখলমুক্ত করে ড. জি সি দেব জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস এলে নানা আলোচনায় বাড়িটি উদ্ধারের কথা উঠলেও পরবর্তী সময়ে সব কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে।
সরেজমিন দেখা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের লাউতা গ্রামে ড. জি সি দেবের পৈতৃক বাড়ির বেশির ভাগ দখলদারদের দখলে। দখলদাররা সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন।
Read More: Chanakya Biography
জানা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্থানীয় বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা রইজ্জুদ আলী ওরফে রইয়া রাজাকার প্রথমে বাড়ির কিছু অংশ দখল করেন। পরবর্তী সময়ে বাড়ির অন্যান্য অংশও বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে রইয়া রাজাকারের ছেলে ছমিক উদ্দিন দখল করা অংশে পাকাঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। অন্য অংশে পরেশ চন্দ্র মালাকার, নরেশ চন্দ্র মালাকার ও হরিপদ মালাকার ঘর নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন।
আধুনিক মানবতাবাদী দর্শনের পথিকৃৎ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা রিপন কলেজে (বর্তমানে স্যার সুরেন্দনাথ কলেজ) দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করে।
ড. জি সি দেব স্মৃতি সংসদের সভাপতি লাউতা ইউপি চেয়ারম্যান এম এ জলিল বলেন, ‘ড. দেব আমাদের অহংকার। আমরা আশা করি, অবিলম্বে তাঁর বাড়িটি দখলমুক্ত করতে যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ।’