Thursday, March 28, 2024
HomeEducationট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার! অদম্যপ্রান এই তরুনের গল্পটি হোক লাখো শিক্ষার্থীর...

ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার! অদম্যপ্রান এই তরুনের গল্পটি হোক লাখো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা

পড়াশোনার খরচ আর পরিবারের দায় মেটাতে এক সময় ট্রাকের হেলপার (ট্রাক চালকের সহকারী) ছেলেটিই তার অদম্য ইচ্ছার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজ বিসিএস ক্যাডার। জন্ম কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পলাশবাড়ির চকিদার পাড়ায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল পরিবারের চতুর্থ সন্তান সে । …. এক জোড়া প্যান্ট শার্ট দিয়ে পুরো স্কুল জীবন পার করতে হয়েছিল তার । স্কুলে একবার নিয়ম করা হলো পায়ে জুতো ছাড়া কেউ স্কুলে আসতে পারবে না। অনন্যোপায় ছেলেটি স্কুলে গেল খালি পায়েই । বসল সবার পেছনে যাতে শিক্ষকের নজরে না পড়ে। শিক্ষক রণহুঙ্কারে ঘোষণা করলেন আজও যারা জুতো ছাড়া এসেছে তারা যেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। আর যারা পরদিন জুতো পরে আসতে পারবে না তাদের স্কুলে আসার দরকার নেই। ………… পরদিন কেউ আর মিস করবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে কজন আনেনি তারা রক্ষা পায়।

কিন্তু পেছনে বসা ছেলেটি অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে। জানে আজই তাঁর স্কুলে আসার শেষ দিন। কেননা, তাঁর জন্য একজোড়া জুতো কেনা আর মহাকাশে চন্দ্রাভিযানের স্বপ্ন একই তখন । না, ছেলেটিকে সে দফায় স্কুল ছাড়তে হয়নি। ছেলেটির অসহায় কান্না দেখে সেদিন ক্লাসের সবাই মিলে এক জোড়া জুতো কেনার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। দারীদ্রতা আর পারিপার্শিকতায় থেমে থাকা হাজারো-লাখো শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা জাগিয়ে অদম্যপ্রান সেই ছেলেটিই ৩৫তম বিসিএসের ভাইভা দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছে এবার। ব্যতিক্রমি এক উদাহারন সৃষ্টি করে দেয়া এই যুবকের নাম মো. শফিকুল ইসলাম। এখন নিজ জেলার পাশের জেলা লালমনিরহাট সরকারি মজিদা খাতুন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার।

শফিকুলের সংগ্রামী জীবনের গল্প এখন কুড়িগ্রামের মানুষের মুখে মুখে। স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা প্রসঙ্গে অকপটেই শফিকুল জানিয়েছে তার জীবনে নানা চড়াই উৎরাই আর প্রতিবন্ধকতার কথা । ………… তখন ২০০৫ সাল। এসএসসি রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে। সেদিন ছেলেটি ট্রাকের হেলপার হিসেবে ট্রাকের সঙ্গে মালামাল পরিবহনে অনেক দূরে ছিল। তাই রেজাল্ট জানতে পারেনি। পরদিন বাড়ি এসে ছেলেটি জানতে পারে দারুন এক বিস্ময় অপেক্ষায় ছিলো তার ! পুরো কুড়িগ্রাম জেলায় মানবিক বিভাগ থেকে সেবার একমাত্র শফিকুলই পেয়েছিলো জিপিএ ফাইভ !পত্রিকায় সেই সংবাদ দেখে সংগীত শিল্পী কনক চাঁপা এই অদম্য মেধাবী ছেলেটির এমন চমকপ্রদ ফলাফলের সংবাদ শুনে তাকে সাত হাজার টাকা শুভেচ্ছা হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। বিভিন্ন বৃত্তি পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ২০০৭-০৮ সেশনে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পেছনে আরও অনেক করুণ গল্পে জানা যায় অসহনীয় সংগ্রামে ভরা এক জীবনের গল্প । বাঁশের চাটাই আর পাটখড়ির বেড়ার জরাজীর্ণ ছোট দু’টি ঘরে জীবনযাপন শফিকুলের পরিবারের। সন্তান বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গৌরব তাদের চোখে-মুখে। ………… কুড়িগ্রাম জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে যার নিয়তি ছিল বাবা আব্দুল খালেকের মত জলিল বিড়ির ফ্যাক্টরিতে কাজ করার। কিন্তু বিড়ির ধোঁয়ায় ঝাপসা আর নিয়ত ক্ষয়িষ্ণু জীবনের চেনা ঘানি সন্তানকে দিয়ে টানাতে চান নি বিড়ি শ্রমিক আব্দুল খালেক। চান নি ছেলেটিও তার এই পেশায় আসুক। দরীদ্র বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তার পড়াশোনা করে অফিসার হোক। ‘গরীবের ঘোড়ারোগ’ দেখে আশেপাশের মানুষের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যও তাকে সইতে হয় ।

শফিকুলের বাবা আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমার ছেলে কষ্টের প্রতিদান পেয়েছে। অনেকের সাহায্য নিয়ে, নিজে অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে শফিকুল। ওর এই সাফল্যে আমরা খুব খুশি।’ বাবা আব্দুল খালেক আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সমস্যার কারণে ইংরেজি ও অঙ্কে খারাপ করছিল শফিকুল। টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়াতে পারিনি ওকে। সংসারে আমার আরও চার ছেলে থাকলেও ওদের কারও সামর্থ্য ছিল না আর্থিক সহায়তা করার। পরে পাশের গ্রামের লাভলু নামের এক শিক্ষার্থী টাকা না নিয়েই প্রাইভেট পড়ায় শফিকুলকে। ওর স্কুলের শিক্ষকরাও টাকা-পয়সা দিয়ে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। স্কুলে ওর বেতন নেওয়া হতো না।

এ কারণেই ও পড়ালেখা করতে পেরেছে। ………… শফিকুলে বাবা-মা জানান, পরীক্ষার পর সংসারের সমস্যা সামলাতে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারেননি শফিফুল। কাঠমিস্ত্রির জোগালদারের কাজ শুরু করেন পরীক্ষার পরই। এই কাজের ফাঁকে ব্যনার, ফেস্টুন লেখাসহ নানা ধরনের আর্টের কাজ করে টাকা উপার্জন করেন তিনি। বেশি টাকা পাওয়া যায় বলে ট্রাকের হেলপারিও করেন শফিকুল। শফিকুল জানান, ক্লাস সিক্সে উঠার পর স্কুলের বেতন না দিতে পেরে স্কুল ছাড়ার উপক্রম হয় । তবে সেসময় এগিয়ে আসেন একজন মহানুভব শিক্ষক; মোজাফফর স্যার! তিনি নিজে শফিকুলের বেতন দেন । পরবর্তীতে স্কুলে বিনাবেতনে পড়াশোনা করার ব্যবস্থাও করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলে উঠে।

সেখানে শুরু হয় আরেক নতুন জীবন। সহস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আরেক নতুন সংগ্রাম। অভাবিত অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। অবশ্য, তাঁর কাছে তখন আর কিছুই অভাবনীয় নয়; অসহনীয় নয়। নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে ঢাকা শহরে লিফলেট বিলি করেছে, কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিদিন দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাই যার কাছে ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। সে সংগ্রামে পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আরও অনেকে। ………… বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে শফিকুল যখন বিসিএসের ভাইভা দেবে। ভাইভার জন্য ফরমাল কোন ড্রেস নেই। এক জুড়ো জুতো, প্যান্ট ও শার্ট লাগবে। পরিচিত সামর্থ্যবান একজনের কাছে এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে দেয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিল।

সারোগেসি সন্তানকে ‘রেডিমেড’ বলে বিতর্কে ইন্ধন, তসলিমাকে পাল্টা একহাত নেটপাড়ার

সাহায্য দূরে থাক উল্টো তাকে চরম অপমান সইতে হয়েছিল সেদিন। এই সংগ্রামের পথচলায় যারা বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে শফিকুল । সে তালিকায় আছেন পাশের বাড়ির মাহবুবুর রহমান লিটন চাচা, ডলার ভাই, ব্যাংকার মোজাহেদুল ইসলাম শামীম ভাই, মুক্তি আর্ট, বানিয়া পাড়ার লাবলু স্যার, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোজাফফর স্যার, মান্নান স্যার, মমতাজ ম্যাডামসহ আরো অনেক শিক্ষক। আছেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জামাল স্যার, সা’দ উদ্দীন স্যার প্রমুখ। শফিকুল বলেন, ‘অভাবের জীবন আমি পদে পদে উপলব্ধি করেছি। আমার শিক্ষক আর কিছু মহানুভব মানুষের সহযোগিতায় আমি আজ এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’ ………… ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ‘আমার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে বাবা-মায়ের থাকার ঘরটির মেরামতের কাজ করাবো।

বাবা-মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালুর স্বপ্ন আছে আমার। তবে সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আমি অবশ্যই আমার মতো অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে চাই। টাকা-পয়সার অভাবে কারও পড়ালেখা যেন থমকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাই আমি।’ এছাড়া, নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার ও বয়স্কদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার ইচ্ছার কথাও জানান ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়া শফিকুল।

সংশয়বাদ কাকে বলে? আমাদের ওয়েবসাইটের নাম কেন সংশয়?

শফিকুল ইসলাম জানালেন, আসছে মাসের বেতনের টাকা দিয়ে ঘরের চাল ঠিক করবেন তিনি। আকাশ থেকে নামা আলোরধারা পুরো সমাজে ছড়িয়ে দিতে চান এই অদম্যপ্রান যুবক। শফিকুল ইসলাম জানান, মে মাসের দুই তারিখে চাকরিতে জয়েন করার আগে বাড়ি যাই। রাতে খাবার খেতে বসে দেখে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে ভাতের থালায় জোছনার আলো ফিনকি দিয়ে নামে। চালের ফুটো দিয়ে আসা এ আলোকে এখন তিনি দেখেন অনুপ্রেরণা হিসেবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার! অদম্যপ্রান এই তরুনের গল্পটি হোক লাখো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা



Hero

Welcome to the future of building with WordPress. The elegant description could be the support for your call to action or just an attention-catching anchor. Whatever your plan is, our theme makes it simple to combine, rearrange and customize elements as you desire.

Translate »