Tuesday, April 16, 2024
HomePhilosophyময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী কি সিরাজউদ্দৌলার পুত্র ছিলেন!

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী কি সিরাজউদ্দৌলার পুত্র ছিলেন!

ধারণা করা হয় পলাশী যুদ্ধের পর সিরাজ ও ধর্মান্তরিত আলেয়ার ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে ময়মনসিংহে পালিয়ে আসেন মামা মোহনলাল। তখনও পেছনে লেগে আছে ক্লাইভ ও মীর জাফরের গুপ্তচর। ব্রিটিশদের চোখের আড়ালে বড় করতে সিরাজ পুত্রকে কৃষ্ণপুর জমিদার বংশে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক যুগলকিশোরের গায়ের রঙ আর সুঠাম দেহের জন্য তাকে আর দশজন বাঙালি থেকে সহজেই আলাদা করা যেত। সম্ভবত নিজের মুসলিম পরিচয়ের জন্যই জমিদারি নিয়ে পরিবারের দুই বিধবার সঙ্গে দীর্ঘ মামলায় জড়ান যুগলকিশোর। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই জমিদারের শেষ জীবন কাটে সিলেটে। সিলেটের যুগল টিলার নামও তার নামানুসারেই।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং হীরা ওরফে আলেয়া। লালা দে পরিবারের কাছ থেকে হীরার এই ছবিটি পান অধ্যাপক অমলেন্দু দে।

ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত খোশবাগে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন শাসক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজ ছাড়াও খোশবাগে তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, আলীবর্দী খানসহ নবাব পরিবারের ৩৪ সদস্যের কবর রয়েছে।

খোশবাগে সিরাজের পাশের কবর বেগম লুৎফুন্নেসার। তার পাশেই আছে আরেকটি কবর। কবরটি আলেয়া বেগম ওরফে হীরার। শোনা যায় সিরাজের প্রাসাদ সংলগ্ন হীরাঝিলের নামকরণ হয় এই হীরার নাম থেকে। কিন্তু কে ছিলেন এই হীরা? ইতিহাসে আলেয়া কিংবা হীরার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় তিনি সিরাজের স্ত্রী। তবে আলেয়ার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন নবাবের বিশ্বস্ত সহচর মোহনলালের বোন।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী সিরাজ ও আলেয়ার পুত্র এমন কিংবদন্তী দীর্ঘসময় ধরেই শোনা গেছে। কিন্তু এর ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মোহনলালের বোন আলেয়াই কি সিরাজের একমাত্র পুত্রের মা? ব্রিটিশ আমলে পরিচয় প্রকাশ পেলে হত্যার শিকার হতে পারে বলেই কি সিরাজপুত্রের পরিচয় গোপন রাখা হয়? মুর্শিদাবাদ থেকেই বা ছয় বছরের সিরাজপুত্র কীভাবে ময়মনসিংহ পৌঁছায়? যুগলকিশোরের বংশধরেরাই বা এখন কে কোথায়?

খোশবাগ। এখানেই শায়িত আছেন নবাব পরিবারের সদস্যরা

সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে

 

২০১২ সালে প্রকাশিত হয় অমলেন্দু দে’র বই ‘সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অমলেন্দু দে। ছিলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সিরাজের বংশধরদের নিয়ে ৫০ বছরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তিনি গবেষণামূলক বইটি প্রকাশ করেন। ২০১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেবছরই বইটি কমরেড মুজফফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার লাভ করে।

 

ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ইতিহাস, সিরাজের বংশধর দাবি করা লালা দে পরিবারের পারিবারিক নথি ও যাদব মহাসভার কাগজপত্র অনুসন্ধানসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে বইটি লেখা হয়। বইটিতে বিস্তারিতভাবে আলেয়া ও সিরাজের সম্পর্ক, মোহনলালের পলাশী যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া ও সিরাজ-আলেয়ার সন্তানকে নিয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার বর্ণনা মিলে।

 

সিরাজের এই পুত্রকে পরবর্তীতে দত্তক নেয় ময়মনসিংহের শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জমিদার বংশ। এই পরিবার নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। পারস্য ভাষা শিক্ষা নিয়ে পরিবারটি যত্নবান ছিল। পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক ইতিহাস রচনাতেও এই জমিদার পরিবারের তথ্য মূল্যবান।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

কে ছিলেন এই আলেয়া?

 

নিখিল নাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ অনুযায়ী, সিরাজের কয়জন স্ত্রী ছিল তা স্থির করা যায় না। তার স্ত্রীদের মধ্যে শুধু তিন-চারজনের কথা জানা যায়। তবে মোহনলালের বোন যে সিরাজের স্ত্রী ছিলেন তিনি তা উল্লেখ করেন। ড. সোনিয়া আমিনের প্রবন্ধ অনুসারে মোহনলালের বোনের নাম আলেয়া। নবাবের প্রাসাদে আলেয়া যে সম্মানিত ছিলেন তা খোশবাগে তার কবর দেখে অনুমান করা যায়।

 

সিরাজের বংশধর দাবি করা লালা দে পরিবারের নথি অনুসারে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে আলেয়ার ডাকনাম ছিল হীরা। হীরা’স লিগ্যাসি শীর্ষক এই নথি অনুযায়ী, মোহনলালের বোনের প্রকৃত নাম মাধবী। মোহনলালের সঙ্গে সিরাজের সখ্যতার সূত্রে হীরার সঙ্গেও সিরাজের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় জন্ম নেয় তাদের পুত্র সন্তান। তবে সেই ছেলের নাম কী ছিল তা জানা যায় না। তাদের যে কোনো পুত্রসন্তান ছিল, এমন তথ্যও কোনো লেখকের রচনায় পাওয়া যায় না। এমনও হতে পারে আলেয়ার সঙ্গে বিয়ের আগেই সন্তানটির জন্ম হয়েছিল বলে সে পূর্ণ স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়।

 

হীরা ও তার ছেলেকে সিরাজ নিজের মহলেই রাখেন। তবে সিরাজের এই সন্তানের কথা আলীবর্দী খান জানতেন না।

 

কথিত আছে, নানার ভয়ে সিরাজ তার পুত্রকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে সেই ঘোড়াকে তীরবিদ্ধ করে ছুটিয়ে দেন। তিনি ভেবেছিলেন আহত ঘোড়াকে থামিয়ে কেউ ছেলেটিকে বাঁচিয়ে আপন করে নিবে। ওদিকে এই সংবাদ পেয়ে হীরা নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মোহনলালের কাছে ছুটে যান। মোহনলাল তখনই নিজের ঘোড়া নিয়ে ছুটে গিয়ে হীরার ছেলেকে রক্ষা করেন।

 

এই ঘটনায় সিরাজের ওপর মোহনলাল প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হন। হীরাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ ত্যাগের সিদ্ধান্ত দেন। মোহনলালের সিদ্ধান্তের কথা জেনে আলীবর্দী খান উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মোহনলালের মতো বিশ্বাসভাজন চলে গেলে সিরাজের ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। এই ভয় থেকেই আলীবর্দী মোহনলালের চলে যেতে চাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে পুরো ঘটনা জানতে পান।

 

তবে নবাব আলীবর্দী মোহনলালকে হারাতে চাননি। আর তাই তিনি মীমাংসা করতে ইমামের পরামর্শে হীরা ও সিরাজের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বিয়ের জন্য হীরাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। ধর্মান্তরিত হীরার নতুন নাম হয় আলেয়া। নবাবের প্রাসাদের যেখানে বিয়ের আয়োজন হয়, তার পাশেই ছিল একটি ঝিল। হীরার নামে সেই ঝিলের নাম রাখা হয় হীরাঝিল।

 

বিয়ের পর আলীবর্দী খান বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করেই সিরাজের এই পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন মোহনলালকে।

ধারণা করা হয় নির্যাতনের পর আলেয়াকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজপুত্রকে নিয়ে ময়মনসিংহ যান মোহনলাল

 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশীর যুদ্ধে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে মোহনলাল নবাবের বিপর্যয়ের কথা বুঝতে পারেন। নিজের ও সিরাজ পুত্রের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে তিনি দ্রুত ছেলেটিকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। খুব সম্ভবত সেই সময় তিনি মীর জাফর ও ইংরেজদের বিভ্রান্ত করতেই তার আহত হওয়ার গুজব প্রচার করেন।

 

মোহনলালের বাসুদেব ও হরনন্দ নামের দুই বিশ্বস্ত দুই ব্যক্তি ছিলেন। পদ্মা নদী পার হয়ে তারা ময়মনসিংহ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় দেন। তবে ক্লাইভ ও মীর জাফর গুপ্তচর পাঠাচ্ছে এই খবর পেয়ে মোহনলাল বুকাইনগর দুর্গে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ মনে করেননি। তিনি সিরাজ পুত্রকে আমহাটি গ্রামে বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায়ের কাছে রাখার ব্যবস্থা করেন।

 

মোহনলাল এরপর সিরাজের পুত্রকে দত্তক নেওয়ার জন্য ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রাজি হলেও তখনই ছেলেটিকে রাখতে পারেননি মোহনলাল। তিনি ও তার দুই সঙ্গী সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর পুনরায় জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনেন, তিনি মারা গেছেন।

 

জমিদার শ্রীকৃষ্ণের বড়ছেলে কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে দত্তক গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করেন মোহনলাল। কৃষ্ণকিশোরের ছোট ভাই কৃষ্ণগোপাল দুবার বিয়ে করলেও তার কোনো সন্তান ছিল না। এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরাজ পুত্রকে দত্তক নেন কৃষ্ণগোপাল। জানা যায়, মোহনলাল ছদ্মবেশে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নামকরণের পর সিরাজপুত্রের নতুন নাম হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী।

 

তবে এই দুই ভাই জানতেন না যে তারা সিরাজের পুত্রকে দত্তক নিয়েছেন। তাদের বলা হয়েছিল ছেলেটি বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

গৌরীপুরের দোর্দণ্ড প্রতাপ জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী

 

ময়মনসিংহের জমিদার পরিবারেই বড় হন যুগলকিশোর। বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি তাদের বিধবা স্ত্রীদের দেখাশোনাসহ জমিদারির দায়িত্ব পান। সেসময় জাফরশাহি অঞ্চলে এক মহামারি দেখা দিলে যুগলকিশোর কৃষ্ণপুর থেকে গৌরীপুর আসেন।

 

গৌরীপুর তখনো জঙ্গলে পরিপূর্ণ। চাষবাসও তেমন নেই। দরিদ্র কিছু পরিবার সেখানে বাস করত। যুগলকিশোরের দক্ষতায় অল্প সময়েই এই অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন ঘটে।

 

কিন্তু একইসময় শুরু হয় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। সঙ্গে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। বন্যার পর বেশ কিছু অঞ্চলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। এসময় সিন্ধা পরগনার জমিদার মহম্মদ খাঁর সঙ্গে যুগলকিশোরের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সিন্ধার প্রজাগণ দলবদ্ধ হয়ে যুগলকিশোরের বেশ কিছু গ্রামে ডাকাতি করে। যুগলকিশোর মহম্মদ খাঁর সাহায্য চাইলে প্রত্যুত্তরে তিনি অবজ্ঞার সাথে উত্তর পাঠান।

 

ক্ষুদ্ধ যুগলকিশোর ১৭৭৯ সালে পাঁচ হাজার লাঠিয়ালসহ সিন্ধা আক্রমণ করে সিন্ধার প্রজাদের ঘর লুট করে আগুনে জ্বালিয়ে দেন। কিন্তু মামলা দায়ের হলেও তার বিরুদ্ধে কেউ স্বাক্ষ্য দিতে রাজি ছিল না। যুগলকিশোরকে লুন্ঠন ও বাড়ি পোড়ানোর নির্দেশ দিতে কেউ শোনেননি বলে তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। তবে তাকে সতর্ক করে অঙ্গীকার পত্র লিখিয়ে নেওয়া হয়।

সিরাজ-আলেয়া থেকে যুগলকিশোর রায়চৌধুরীর বংশলতিকা। সূত্র: ত্রিপুরা টাইমস

জ্যাঠাইমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সিলেটে শেষ জীবন

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

এসময় পারিবারিক বিবাদেও জড়িয়ে পড়েন যুগলকিশোর। তার জ্যাঠার বিধবা দুই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

 

যুগলকিশোরের গায়ের রঙ আর সুঠাম দেহ দেখে তাকে আর দশজন বাঙালি থেকে সহজেই আলাদা করা যেত। তার গায়ের রঙ, সুঠাম দেহ দেখে জ্যাঠাইমারা তাকে বিজাতীয় সন্দেহ করে থাকতে পারেন। দীর্ঘদিনের মামলা মোকাদ্দমা থেকে ধারণা করা হয় এই বিধবারা যুগলকিশোরের মুসলমান পরিচয় সম্পর্কে আঁচ করেছিলেন।

 

ব্রিটিশ রাজত্বে তার পরিচয় প্রকাশ হলে তিনি বিপদে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কা থেকে তিনি জমিদারি সমৃদ্ধি ও শক্তিসাধনায় মনোনিবেশ করেন। ময়মনসিংহের অনেক জায়গায় কালীমন্দির ও শিবলিঙ্গও তার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারপরও মুসলমান হিসেবে তাকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতে পারে এই ভাবনা থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি গৌরীপুর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

সিলেটের কাজল শহরে বিস্তৃত জমিদারি কিনে দ্বিতীয় স্ত্রী ও ছেলে প্রাণকৃষ্ণনাথকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন যুগলকিশোর। সিলেটে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবন শুরু করেন তিনি। সেখানে কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না। সম্ভবত কোনোভাবে নিজের অতীত জানতে পেরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। ১৮১১ বা ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয় এবং শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কাজল শহরের পারিবারিক জমিদারিতে গোপনে তাকে কবর দেওয়া হয়।

 

মৃত্যুর আগে ছেলে প্রাণনাথকৃষ্ণের কাছে নিজের জন্মবৃত্তান্ত বলেন যুগলকিশোর। ব্রিটিশ শাসনকালে এই সংবাদ গোপন রাখার প্রয়োজনীয়তাও ছেলের কাছে ব্যাখ্যা করেন। ভবিষ্যতে তার বংশধররা সবাই যেন সিলেট না থেকে পদবী পরিবর্তন করে শিলং যায় সেই নির্দেশনাও দেন তিনি।

 

যুগলকিশোরের ছেলে কৃষ্ণনাথ সিলেটের উন্নতিতে অবদান রাখে। তিনিই সিলেট লেক ও যুগল টিলা আখড়ার জন্য জমি দান করেন।

 

বংশ পদবী পরিবর্তন

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

যুগলকিশোরের ছেলে প্রাণকৃষ্ণনাথের প্রথম ছেলে কাজল মাত্র ১২ বছর বয়সে মারা যান। দ্বিতীয় ছেলে নাম ছিল শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী। প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করতেন। তিনি ১৮৫৫ সালে আর্টস নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। পরবর্তীতে তিনি পুনরায় নাম পরিবর্তন করে হন প্রসন্নকুমার দে। এভাবেই রায়চৌধুরী থেকে পরিবারের পদবী দে-তে পরিবর্তিত হয়।

প্রসন্নকুমার দের প্রথম স্ত্রীর ছেলের নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। অনেকেই তাকে সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। নাম এক হলেও তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই মানুষ।

 

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনেও জড়িয়ে আছে এই পরিবারের নাম। মহাত্মা গান্ধীর স্বাধীনতা বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন প্রসন্নকুমার দের তৃতীয় স্ত্রীর ছেলে লালা শরদিন্দু দে বা বুনি বাবু। ১৯৩৫ সালে সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শরদিন্দু। বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় শরদিন্দু ও তার স্ত্রী সুষমা পুরকায়স্থ বহুবার কারাবন্দী এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭০ সালে তারা ভারতের আগরতলায় চলে যান।

 

বর্তমানে এই পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় আছেন

 

লালা দে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও পরিবারের কয়েকজন সদস্যের মুসলিম ও খ্রিস্টান পরিবারের সঙ্গেও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে। এখনও পুরো পরিবারটি উদারপন্থী ধারা বজায় রেখেছে।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

যুগলকিশোরের সূত্রে সিরাজের ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর লালা অজয় কুমার দে। বর্তমানে তিনি ভারতের দিল্লিতে বসবাস করেন এবং গ্লোবাল কনসিয়াজ ইন্ডিয়ার সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন। গত বছরের আগস্টে টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদের বংশসূত্র বেশ গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষিত ছিল। আমরা জানতাম কোনো না কোনোভাবে মোহনলালের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। অধ্যাপক দে আমাদের সেই সুত্র মেলাতে সাহায্য করেছেন।”

 

অজয় আরও জানান শিলং-এ থাকতে নয় বছর বয়সে দাদুর কাছে এই পারিবারিক গোপনীয়তার বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। তার দাদু লালা বিজয় কুমার দে তাকে বলেছিলেন, মীর জাফরের সঙ্গে ব্রিটিশরাও মোহনলালকে ধরতে জাল বিছিয়েছিল। মোহনলাল আলেয়াকে একটি সুরক্ষিত জায়গায় রেখে চলে যান। কিন্তু তার পক্ষে আর ফিরে এসে আলেয়াকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নির্যাতনের পর আলেয়াকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

আবু ধাবিতে থাকেন এই পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের উত্তরসূরী লাল শ্যামল দে। তিনি জানান, অমলেন্দু দের বই প্রকাশিত হওয়ার পর ভাইবোন ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ যান তারা।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

শ্যামল আরও জানান তাদের পরিবারের এক সদস্যের ডিএনএ পরীক্ষা থেকে আরবীয় বংশসূত্র পাওয়া গেছে। পরিবারের অন্যান্যদের ডিএনএ পরীক্ষা হলেও একই জিনিস পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। আলীবর্দী খানের বাবা মোগল দরবারের কর্মকর্তা মির্জা মুহম্মদ মাদানি তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিলেন বলে এই তথ্যটি তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার য

দে পরিবারের তথ্য অনুযায়ী সিরাজের সপ্তম প্রজন্মের বংশধর ব্যারিস্টার আতিয়ার দে এখন লন্ডনে থাকেন। টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার কাছে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সবাই জানতে চায় আমরা কারা এবং কোথা থেকে এসেছি”।

 

এই পরিবারের আরেক সদস্য লেখিকা বিজয়া সাভিয়ান। বিজয়া সম্প্রতি পূর্বপুরুষদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেখানে সিরাজের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ আছে। শীঘ্রই বইটি প্রকাশিত হবে। প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক ভারতের অতীত ও ইতিহাসের পুনর্লিখনেও সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক এই পরিবার।

 

সিরাজ প্রকৃতপক্ষেই যুগলকিশোরের বাবা ছিলেন কিনা তা হয়তো এখনো নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এর জন্য সম্ভবত আরও বহু অনুসন্ধান, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও ডিএনএ পরীক্ষার মতো উন্নত ফরেনসিক বিজ্ঞানের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে। তবে এই পুরো কাহিনী যে চমৎকৃত হবার মতো তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী কি সিরাজউদ্দৌলার পুত্র ছিলেন!



Hero

Welcome to the future of building with WordPress. The elegant description could be the support for your call to action or just an attention-catching anchor. Whatever your plan is, our theme makes it simple to combine, rearrange and customize elements as you desire.

Translate »