অদম্য সেই ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে সবই সম্ভব তা প্রমাণ করে দিলেন সুপর্ণা দে। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ৩৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পরীক্ষার আগের দিন প্রসবব্যথা উঠল। রাতে নেওয়া হলো হাসপাতালে। ভোর সাড়ে চারটায় তাঁর কোলজুড়ে এল ছেলে। সকাল ১০টায় পরীক্ষা। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কেন্দ্রে গেলেন।
তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত শরীরে ফিরলেন নবজাতকের কাছে। অদম্য সেই ইচ্ছাশক্তির জোরেই সুপর্ণা দে এখন বিসিএস ক্যাডার। ৩৫তম বিসিএসে (প্রাণিসম্পদ) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১১তম হয়েছেন তিনি। সুপর্ণা দে বলেন, ‘আমার কাছে এখনো পুরো ঘটনা অলৌকিক মনে হয়। আমার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত পেরেছি।’ বিসিএসে উত্তীর্ণদের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি অভিনন্দনবার্তার সূত্র ধরে জানা যায় সুপর্ণার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী।
বাবা-মা দুজনেই স্কুলশিক্ষক। ২০০৩ সালে বাঁশখালী গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু দ্বিতীয় সেমিস্টারে থাকতেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। অবশ্য বিয়ের সময়েই পাত্রপক্ষের কাছ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন। ২০১২ সালে পাস করেন সুপর্ণা। সে বছরের ডিসেম্বরে মেয়ের মা হন তিনি। ২০১৪ সালে ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দিলে আবেদন করেন। গত বছরের ৬ মার্চ যখন প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়, তখন তিনি আবার অন্তঃসত্ত্বা।
বিসিএসের জন্য সিরিয়াসলি না পড়েই বিসিএসে প্রথম হয়েছেন উর্মিতা!
প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চিকিৎসকেরা জানান, সন্তানের জন্ম হবে সেপ্টেম্বরের শেষে। এতে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন তিনি। কারণ, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লিখিত পরীক্ষা। ১ সেপ্টেম্বর ইংরেজি, পরদিন বাংলাদেশ বিষয়াবলি, ৩ সেপ্টেম্বর সকালে গণিত, বিকেলে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির পরীক্ষা দেন। ৬ সেপ্টেম্বর ছিল সাধারণ ক্যাডারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষা।
কিন্তু সেদিন সকালেই তীব্র ব্যথা শুরু হলে পরীক্ষাটি দেওয়া হয়নি। ফলে প্রশাসন, পুলিশের মতো সাধারণ ক্যাডারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েন। তবে এই পরীক্ষা না দিলেও পেশাগত ক্যাডারের জন্য বাকি পরীক্ষাগুলো দেওয়া যায়। ৭ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলা পরীক্ষা। স্মৃতিচারণা করে সুপর্ণা বলেন, ‘৬ সেপ্টেম্বর রাতেই আমাকে চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লার মা ও শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভোর সাড়ে চারটায় ছেলের জন্ম। ভাবলাম, যে করেই হোক পরীক্ষা দেব। অ্যাম্বুলেন্সে করে সকালে কেন্দ্রে গেলাম। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পরীক্ষা দিলাম। লিখিত পরীক্ষার ফল দিলে দেখি উত্তীর্ণ হয়েছি। ভীষণ ভালো লাগল। মনে হলো স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছেছি। মৌখিকও ভালো হলো।
বুধবার চূড়ান্ত ফল দেখে মনে হলো, পৃথিবী জয় করেছি।’ সুপর্ণার মা বাঁশখালী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা অপর্ণা নন্দী। মেয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের অনুরোধে চিকিৎসকেরা স্বাভাবিক প্রসব করান। মেয়েটাও পরীক্ষা দিল। আজ আমরা খুব খুশি।’ সুপর্ণার বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপনেন্দু দেও মেয়ের সাফল্যে আনন্দিত। সুপর্ণা শুধু সংসার করছেন দেখে হতাশ হতেন স্বামী ব্যবসায়ী টিটো শিকদার। বললেন, ‘স্কুল থেকে ফিরে সংসার সামলানো, বিসিএসের প্রস্তুতি। পেটে আরেকটা বাচ্চা। কিন্তু ও সব জয় করেছে।’