গণতন্ত্রের মানসপুত্র, উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ রোববার। ১৯৬৩ সালের এই দিনে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটি হোটেল কক্ষে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান তিনি।
১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে। তিনিসহ আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’, যার সভাপতি নির্বাচিত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পদত্যাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন তিনি।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় বিশতম স্থানে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আজ তাঁর জীবন-কথা তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা।
পাঠকদের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো-
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নামে একটি দল গঠন করে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ৮ই সেপ্টেম্বর ১৮৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায়। তাঁর পিতা স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক।
অনেকটা পারিবারিক ঐতিহ্য মেনেই তিনি আইন পড়তে যান ইংল্যাণ্ডে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং আইনজীবী হিসাবে কিছুদিন কাজও করেন ব্রিটেনে।
সোহরাওয়ার্দী ১৯২০ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং পরের বছর বাংলা প্রাদেশিক সভায় সদস্য নির্বাচিত হন।
সাংবাদিক এবিএম মুসা বিবিসি বাংলাকে বলেন, সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবনে আরও সাফল্য আসে ১৯৪৬ সালে, যখন তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় অবিভক্ত বাংলার প্র্রথম মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা। উনি বস্তুত খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগ দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে যে পাকিস্তান গঠিত হয়, সেই পাকিস্তানের যে প্রদেশগুলি ছিল, যেমন বাংলা, সিন্ধু, বালুচিস্তান, পাঞ্জাব, ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, তার মধ্যে বাংলা ছাড়া আর কোথাও মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার ক্ষমতায় থাকাকালেই ১৯৪৬ সালে ঘটে কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হিসাবে ভারতে এসে উপমহাদেশ ভাগ করার পরিকল্পনা পেশ করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেখা করলেন শরৎচন্দ্র বসুর (কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, পেশায় ব্যারিস্টার) সঙ্গে। দুজনেই অবিভক্ত বাংলার ব্যাপারে একমত হলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং কংগ্রেসের অন্য সদস্যরা।
ভারত ভাগ হলো, ভাষার ভিত্তিতে নয়, ধর্মের ভিত্তিতে।
এবিএম মুসা বলেন, দাঙ্গাটা হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগাস্ট। সেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সম্পর্কে যেটা বলা হয় যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর একটা দায়িত্ব ছিল এই দাঙ্গাটা থামানোর। সেই দায়িত্বটা তিনি পুরোপুরি পালন করতে পারেননি। দেশ বিভাগের পর আরেকটি দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতায়। সেই দাঙ্গাটা থামানোর ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী সাহেব, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন কিন্তু দেশ ভাগ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ব্রেইনকে শাণিত রাখতে এই অভ্যাসগুলো জরুরি
সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর কলকাতায় থেকে গেলেন ।
এবিএম মুসা বলেন, ওঁনার যারা অনুসারী বা ভক্ত ছিলেন, তারা তাঁর জন্য তখন একটা মঞ্চ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, যেখান থেকে তিনি ওই অঞ্চলে রাজনীতি করতে পারেন। খাজা নাজিমউদ্দীন তখন এখানকার (পূর্ব পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী। তিনি চাননি যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব এখানে আসুন। তারপর ১৯৪৮ সালে তিনি আসলেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে স্টিমার থেকে তাকে নামতে দেওয়া হয়নি। বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে, সেখান থেকে ফিরতি স্টিমারে তাকে কলকাতা ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিগ লীগ গঠিত হল ১৯৪৯ সালে, যা ১৯৫৩ সালে রূপান্তরিত হয় আওয়ামী লীগ নামে।
বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ইতোমধ্যেই আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কথাও তখন তুলছেন কেউ কেউ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকাপাকিভাবে চলে গেছেন পূর্ব পাকিস্তানে।
মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে উদ্যোগী হলেন।
মুসা বলেন, বিশেষ করে মওলানা ভাসানি এবং একে ফজলুল হক (শেরে বাংলা), এই দুজন যদিও ছিলেন ভিন্নমতাবলম্বী কিন্তু তাদের সাথে নিয়েই বিশেষ করে যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগী হন মি. সোহরাওয়ার্দী।
“সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজে তাদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করলেও তিনজনে একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এবং তার উদ্যোগের ফলেই এই যুক্তফ্রন্ট বহুবার ভেঙে যেতে যেতেও টিঁকে গেছে,” বলেছেন এবিএম মুসা।
এরপর সোহরাওয়ার্দী মহম্মদ আলী বগুড়ার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন আইনমন্ত্রী হিসাবে। রচিত হল পাকিস্তানের সংবিধান। তিনি ১৯৫৬ সালে নির্বাচিত হলেন পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে।
“যদিও পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, কিন্তু ওঁনার উদ্যোগ ছিল সাম্য আনা, যাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় সে ব্যাপারে তিনি একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি বলে ফেললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি, তাতেই তো ৮০ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এসে গেছে।”
এবিএম মুসা বলেন, সেজন্য তাঁকে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।
সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একবছরের সামান্য কিছু বেশি সময়। এরপর ১৯৫৮ সালে জারি করা হয় সামরিক শাসন। স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
এবিএম মুসা বলছেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা। বাংলাদেশে যারাই বড় মাপের নেতা হয়েছেন, তাদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তাদের বিরাট আত্মা- ‘বিগ হার্ট। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ছিল বিরাট আত্মা, জনগণের জন্য ছিল তার অবারিত দ্বার।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মারা যান বৈরুতে ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর। তবে তার আগেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অগ্র-পুরুষ হিসাবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।
আরও পড়ুন: নারীর কি পুরুষের মতো বীর্যপাত হয় ?
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক: প্রধানমন্ত্রী
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকাশের জন্য এ অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সারাজীবন কাজ করে গেছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার (৫ ডিসেম্বর) ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী’ উপলক্ষে শনিবার (৪ ডিসেম্বর) দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
আরও পড়ুন: এন্ড্রয়েড ফোন ফ্যাক্টরি রিসেট করার নিয়ম