১৯৭১ সালের এক শীতের দিন; দুপুর গড়িয়ে পড়ছে। সুরবালা মল্লিক ঘরের মেঝেতে বসে মেয়েকে বুকের দুধ দিচ্ছিলেন; ওই সময় হানা দেয় একদল পাকিস্তানি সেনা। কোলের সন্তানকে ছুড়ে ফেলে তুলে নিয়ে যায় সুরবালাকে। নিজেকে রক্ষার সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন যুদ্ধের ময়দানে আটকেপড়া এই নারী।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিভৃত পল্লি মাধবপুর। সেই গ্রামেরই বাসিন্দা যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিক। যুদ্ধের শুরুতেই গ্রামের অনেকেই শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু সুরবালার স্বামী যেতে পারেননি। একে তো সুরবালার কোলে তিন-চার মাসের সন্তান। তাছাড়া দেশ ছাড়লে খাবেন কী – এই চিন্তায় আর বাড়ি ছাড়লেন না।
“সেই তো বিপদ হইল। আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছিলাম। কিন্তু পরে আবার ফিইর্যা আসছি। তার কয়েকদিন পরেই তো…,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন সুরবালা।
স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রী বিক্রি করছেন ঝাল ফুচকা
মাধবপুর গ্রামটি ভৌগোলিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খানিক দূরেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ, সেটি গিয়েছে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে। যোগাযোগের জন্য পথটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য খুব সহজ ছিল। কাছেই ইজ্জতপুর বড় রেলসেতু; পাহারা বসেছে জায়গায়-জায়গায়। বলতে গেলে, সেনা গ্যারিসনের পেটের মধ্যেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটি।
যুদ্ধের সেই দিনের বর্ণনা করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালা। শ্রীপুরের রাজাবাড়ী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম আকন্দও সেদিনগুলোর কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
সুরবালা বলেন, “নানা জায়গা থাইক্যা মানুষ মারার খবর আনত রিপনের বাপ (যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিক)। শুইন্যা ভয় লাগত। বড় মাইয়্যাটা মাত্র হইছে। সাতখামাইরে মানুষরে দাঁড় করাইয়া মারছে রেললাইনের পাশে। প্রতিদিনই তো গোলাগুলি হইত।”
অন্তঃসত্ত্বা তামিমার ছবি প্রকাশ্যে আনলেন ‘অবৈধ স্বামী’ নাসির
সুরবালাদের নিম্নবিত্ত পরিবার। স্বামী যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিকের কিছু জমিজমা ছিল, তা দিয়েই তিনি কোনোরকমে পরিবার চালান। কৃষিকাজ বন্ধ থাকলে খাওয়াও বন্ধ। যুদ্ধের বাজারে তখন কৃষিকাজ করাও মুশকিল।
গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবারই শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। কিছু পরিবার এ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে গেছে আত্মীয়ের বাড়ি। তবে মুসলিম পরিবারগুলো প্রায় সবই ছিল; তাদের সঙ্গে কয়েক ঘর দরিদ্র হিন্দুও থেকে যায়।
স্মৃতি কাতরতা নিয়েই গত সপ্তাহে নিজের বাড়িতে বসে সুরবালা রায় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এসব কথা বলছিলেন। এখন আর নিজে নিজে চলতে পারেন না। ছয় বছর আগে বৃষ্টির মধ্যে পিছলে উঠানে পড়ে যান, তখন থেকেই চলতে-ফিরতে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। চোখেও কম দেখেন। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছেন তিনি। বাড়িতে ছোট ছোট তিনটি মাটির ঘর। তার একটিতে থাকেন এই নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা; কথা বলেন ধীরে ধীরে।
পুলিশ ভেরিফিকেশন কী ও কেন করা হয়?
সুরবালা বলছিলেন, “আমার বড় মেয়ের বয়স তখন প্রায় এক বছর। সেনারা আইলে আমরা লুকাই, অন্যখানে চইল্যা যাই। এইভাবে আর কতদিন। সবখানে হামলা-নির্যাতনের খবর পাইতাছি। কাওরাইদ, সাতখামাইর, গোলাঘাট রেল ব্রিজ, ইজ্জতপুর ব্রিজ ও বলদি ঘাটে ক্যাম্প আছিল। কলেজের (শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজে) মধ্যে অনেকরে হিন্দু-মুসলমান মিলায় কবর দিছে। কেওয়া, উজিলাব, ইজ্জতপুর, গোসিঙ্গায় মারছে। পরে একদিন মেয়েরে নিয়া ঘরে তালা দিয়া কালীগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাই।
“একদিনে রিপনের বাপে কয়, এলাকায় পাক-সেনাদের আক্রমণ কমে আসছে। মুক্তিবাহিনী ঢুকছে। সেনারা ক্যাম্প থেকে বাইর হয় না। পরে আবার কালীগঞ্জ থেইক্যা মেয়ে নিয়া আমরা শ্রীপুরের বাড়ি ফিইর্যা আসি।”
Source of bdnews24